শনিবার , ৩০ আগস্ট ২০২৫ | ২৬শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাহাড়ে কফি-কাজু বাদামেই চাষিদের ভাগ্য পরিবর্তনের অপার সম্ভবনা

প্রতিবেদক
বার্তা বিভাগ
আগস্ট ৩০, ২০২৫ ১০:২৫ অপরাহ্ণ

বান্দরবান প্রতিনিধি:

পাহাড়ি জেলা বান্দরবানে এক সময় জুমিয়ারা জুম চাষে সীমাবদ্ধ থাকলেও যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন ফলজ বাগানের দিকে ঝুঁকছে তারা।

বান্দরবানের পাহাড়গুলো এখন সনাতন কৃষি থেকে বের হয়ে আধুনিক কৃষির সাম্রাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করছে। আর এ প্রচেষ্টার সিংহ ভাগ জোগান দিচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প।
যার মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় ও ক্রমবর্ধমান ভাবে বেড়ে চলেছে কফি ও কাজুবাদাম গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’।

এক সময় চাষিরা খোসা যুক্ত কাজু বাদাম প্রতি মণ (৪০ কেজি) ১৮শ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি করলেও বর্তমানে ৬-৭ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
খোসাযুক্ত কফি চেরি ফল টন প্রতি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২ লাখ টাকায়।
যা কৃষকদের ভাগ্য বদলাতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা বহন করছে।
বর্তমান দেশের সব থেকে দরিদ্র এই জেলাটিতে কফি-কাজু বাদাম আবাদের মাধ্যমে জনগনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী জেলা হিসেবেও পরিচিতি লাভ করবে।

কৃষি অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ু এ দুই ফসলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় তিন পার্বত্য জেলায় কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে
দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প গ্রহন করা হয়। প্রকল্পের শুরুর দিকে যেখানে দেশে
কাজুবাদামের চাষ হতো মাত্র ১ হাজার ৮০০ হেক্টরে, সেখানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২০০ হেক্টরে। কফির ক্ষেত্রেও একই চিত্র
মাত্র ৬৫ হেক্টর থেকে বেড়ে ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। জুমের ঐতিহ্য বুকে নিয়ে আধুনিকতার হাত ধরে পাহাড়ের কৃষি
সম্ভাবনার নতুন পথে হাঁটছে। পাহাড় এখন শুধু ইতিহাসের নয়, আধুনিক কৃষিরও নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। খোরপোশ কৃষি থেকে
বাণিজ্যিক কৃষির দিকে এই পার্বত্য এলাকার চাষীদের পদার্পন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক নতুন দিগন্ত হিসেবে গননা করা হচ্ছে।

কফি চাষি ঙুইইন ম্রো জানান, ২০১৫ সালে এক আত্মীয়ের পরামর্শে ১ হাজার চন্দ্রগিরি কফি গাছের চারা রোপণ করেন। বর্তমানে প্রায় ৪ হাজার কফি গাছ আছে। যার মধ্যে ১ হাজার গাছ থেকে বছরে প্রায় দেড় টন চেরি পাওয়া যায়। চেরি হিসেবে যার বাজারমূল্য প্রায় ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। সব গাছে একই সঙ্গে ফলন পাওয়া গেলে বছরে অন্তত ১০ টন কফি চেরি উৎপাদন হবে। এক মৌসুমে যার বাজারমূল্য ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা হবে।

বলিপাড়া ইউনিয়নের বিদ্যামনি পাড়ার কাজু বাদাম চাষি ফোসা উ মারমা বলেন, কৌতূহল থেকে পাঁচ একর জায়গায় কাজু বাদাম গাছ লাগিয়েছিলেন এবং ৪ বছরের মধ্যেই ফলন এসেছিল। একসময় বাগানেই পঁচে যেত, বিক্রি হতো না। খাওয়ার মতো লোকজনও নেই। এমনিতেই পড়ে থাকতো। এখন প্রতি মৌসুমে প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাগানে এসে কাজু বাদামের খোঁজ-খবর নেন। অনেকে আবার বাড়ির আঙিনা থেকেই কিনে নিয়ে যান।

কিষাণঘর অ্যাগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কাজুবাদাম চাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত করছি। প্রথমে ১২০ জন কৃষক নিয়ে চাষাবাদ শুরু করলেও এখন ৯৫০ জন কৃষক বাদাম উৎপাদনে কাজ করছেন।’

তিনি বলেন, ‘দেশে কাজুবাদামের চাহিদা প্রচুর, যার সিংহভাগ এখনো আমদানি হয়। এছাড়া বিদেশে বড় রপ্তানির বাজারও রয়েছে। আমাদের চাষাবাদ আরও বাড়লে ভবিষ্যতে বাদামের ব্যাপক সরবরাহ পাওয়া যাবে। আশা করছি, আমরা রপ্তানিতেও যেতে পারবো।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে,
চাষীদের কফি ও কাজুবাদাম চাষে আরো মনোযোগী
হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন তারা। মাত্র ৬ জন মাঠ সংগঠক দিয়ে ১২ টি উপজেলায় ২০০০ বাগানের টার্গেট থাকলেও ১৭১৬ টি বাগান স্থাপন
হয়েছে। উল্লেখ্য এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ২৫ জন মাঠ কর্মীর মধ্যে ৬ জন মাঠকর্মী (নন কৃষিবিদ) দিয়ে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে
হয়েছে। তা স্বত্তেও প্রকল্প সহায়তা হিসেবে গুনগত মানের প্রশিক্ষণ, উন্নতমানের উচ্চ ফলনশীল চারা, ভালমানের সার, উন্নতমানের
আন্ত:ফসলের বীজ-চারা, বালাই দমনে ন্যাপস্যাক স্প্রেয়ার, আন্ত:পরিচর্যায় সিকেচার, গ্রুপ ভিত্তিক চাষীদেরকে ফুট পাম্প, বুশ কাটার, সেচ
পাম্পসহ পানির ট্যাংক, পানির ড্রামসহ, ৯ টি ড্রিপ ইরিগেশন, ৪টি জিএফএস ৪টি বাঁধ, জৈব সার তৈরীর উপকরণসহ কৃষকদের প্রাপ্য
সকল উপকরণ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ড বিতরণ কমিটির মাধ্যমে স্বচ্চতার সাথে চাষীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।

সরকার নির্ধারিত
প্রক্রিয়ায় সচ্ছতার সাথে ক্রয় করে ৬০ সজতাংশের টাকা খরচ করে ৯০ শতাংশ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। বাকী টাকা বিধি মোতাবেক ফেরত দেয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে চাষীদেরকে গাছ রোপন ও পরিচর্যা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও উদোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ।
উদোক্তা প্রশিক্ষণে স্থানীয় কৃষি বিভাগের পাশাপাশি, স্থানীয় ব্যাংক ম্যানেজারের মাধ্যমে কৃষি ঋণ প্রাপ্তির উপায়, এগ্রিকালচার মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তাদের
মাধ্যমে কফি ও কাজুবাদাম বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া, এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দেশে ও দেশের বাইরে মার্কেটিং চ্যানেল সৃষ্টি,
ই-বিজনেস কার্যক্রমের জন্য অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকদের দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। লোকবল সংকট থাকা স্বত্ত্বেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পার্বত্য
চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সফল হয়েছে। ১৭১৬টি বাগানের মধ্যে ৬০ শতাংশ বাগানে ভালভাবে ফুল-ফল আসা শুরু হয়েছে। ১৭১৬ টি বাগান যখন
পুরোদমে ফলন দেয়া শুরু করবে দেশে কফি ও কাজুবাদাম উৎপাদনের বর্তমান চিত্র অনেক দূর এগিয়ে যাবে। বর্তমানে দেশে কাজুবাদামের
বাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং কফির ৬০০ কোটি টাকা।

বান্দরবানে কৃষিবিদ তরিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে কৃষাণ
ঘর এগ্রো ও রাঙামাটিতে জনাব সাব্বির আহমেদ দীর্ঘদিন দরে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ করে আসছেন। কফি প্রক্রিয়াজাতকরণে আবুল
খায়েল গ্রুপ, নর্থ এন্ড রোস্টারসহ অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসাতে কফি চাষীদের বর্তমানে সুদিন চলছে। ফুল ফোটার
সময় থেকেই পাইকাররা কফি ফল কেনার জন্য চাষীদের সাথে প্রতিযোগীতামূলক দাম নিয়ে যোগাযোগ করতে থাকে। তিন পার্বত্য জেলার
দুর্গম পাহাড়ী এলাকা যেখানে পণ্য পরিবহনের খরচ বেশি সেখানে কফি কাজুবাদাম বিক্রয় করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি বেকার
সমস্যার সমাধান, অনাবাদি উচুভূমি চাষের আওতায় আনা,পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, ভূমিক্ষয়রোধ, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়সহ বহুমূখী সম্ভাবনা
রয়েছে কফি কাজুবাদাম চাষে। “বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর অব্যবহৃত জমি রয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ হেক্টরে
কফি চাষ করলে দুই লাখ টন কফি উৎপাদন সম্ভব, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

প্রকল্প পরিচালক কৃষিবিদ মো: জসীম উদ্দিন বলেন পাহাড়ের এই কফি কাজুবাদাম
চাষের সম্ভাবনাকে দেখে প্রক্রিয়াজাতকরণে সম্প্রতি এগিয়ে এসেছে বড় বড় শিল্প গোষ্ঠি। বিশেষ করে প্রাণ গ্রুপ, বিএসআরএম গ্রুপ, কাজী
গ্রুপ ও লালতীর এর মতো প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি পর্যায়ে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ভবিষ্যতে মানুষ তিন পার্বত্য জেলাকে কফি কাজু বাদামের জন্য ব্যাপকভাবে সুনাম অর্জন করবে।

সর্বশেষ - বান্দরবান জেলা